আল্লাহকে যারা পাইতে চান ?

আল্লাহকে যারা পাইতে চান ?

মূসা আলাইহিস সালাম আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার এমন একজন নবি, যার জীবন থেকে আমরা কুড়িয়ে নিতে পারে নিজেদের জীবনের জন্য অনেক অনেক পাঠ।  মাদইয়ানে মূসা আলাইহিস সালামের আগমন, গাছের নিচে বসে জিরিয়ে এবং  নেওয়া দুজন নারীর বকরিকে পানি পান করানোর  ঘটনাটা  ইতিমধ্যেই  আমরা আলোচনা করেছি। সেখান থেকে আরেকটা জীবন দর্শন কুড়িয়ে আনতে সেই ঘটনাতে আমরা সংক্ষিপ্তকারে আরেক বার চোখ বুলাবো।

দুজন নারী একটা কুপ থেকে নিজেদের বকরিকে  পানি পান করাতে এসেছিলো৷  কূপের কাছে এসে তারা দেখল - অনেকগুলো পুরুষ মানুষ কুপ থেকপ পানি উঠাচ্ছে নিজ নিজ প্রয়োজনএ।  যেহেতু কূপের কাছে অনেকগুলো পুরুষ মানুষের আনা গোনা,  তাই রমণীদ্ব কূপের কাছে না গিয়ে অদূরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করাকেই শ্রেয় মনে করলো।  পুরুষেরা চলে গেলে কেবলমাত্র  কূপের কাছে যাবে - এমনটাই তাদের সিদ্ধান্ত।

সময় গড়িয়ে  যায়, কিন্তু কূপের কাছে থেকে পুরুষদের উপস্থিতি কমে না।  ওদিকে নারীদের ঘরে আছেন তাদের বৃদ্ধ পিতা, যিনি  উন্মুখ হয়ে অপেক্ষা করছেন নিজ কন্যাদের ঘরে ফিরে আসার।  একদিকে বৃদ্ধ পিতাকে দেখভালের জন্য ঘরে ফিরবার তাড়া, অন্যদিকে পুরুষদের আনাগোনার কারণে কুপের কাছে যেতে না পারা - নারীদের জন্য ব্যাপারটা বিপত্তির- ই বটে।

মূসা আলাইহিস সালাম কাছাকাছি কোন এক গাছের ছায়ার নিচে বসে বিশ্রাম করছিলেন।  নিজ মাতৃভূমি ছেড়ে সেই দিনই তিনি দূর পরবাসের মাদইয়ানে পা রেখেছিলেন।  চেনেন না এখানকার জনপদ,  পরিচিত নন কোনো কৃষ্টি- কালচারের সাথেও।

নারীদ্বয়ের বিপত্তিটা চোখ এড়ালো না মূসা আলাইহিস সালামের।  বেশ অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে থাকা এবং কূপের কাছে   ঘেঁষতে না পারার কারণটা বুঝতে পারলেন তিনি।  স্থির করলেন - রমণীদ্বয়ের বকরিগুলোকে তিনি নিজ দায়িত্বে পানি খাইয়ে আনবেন।  এতে করে তাদেরকে পুরুষদের মাঝে আসতে হবে না এবং দূরে দাঁড়িয়ে গুনতে হবে  না অপেক্ষার  প্রহর ।

মূসা আলাইহিস সালাম তাদের বকরিগুলোকে নিজ দায়িত্বে পানি খাওয়ে আনলেন।  তার পরের ঘটনাগুলো আমাদের জানা একজন অপরিচিত লোক তাদেরকে সাহায্য করেছে এই গল্প মেয়েরা তাদের বৃদ্ধ বাবার কাছে করতে ভুলেনি। সবকিছু শুনে মেয়েদের বাবাও খুশি হলেন এমন পরোপকারী আল্লাহর বান্দাকে পুরস্কৃত করতে চাইলেন। মেয়েদের একজনকে পাঠিয়ে তিনি মুসা আলাইহিস সালামকে।

মুসা আলাইহিস সালাম তাদের বাড়িতে উপস্থিত হওয়ার পর  মেয়েদের একজন তাদের পিতাকে বললেন, 

বাবা আপনি বরং এই ছেলেকে কাজের জন্য রেখে দিন এমন লোককেই তো  আপনার কাজে নিযুক্ত করা উচিত যে কিনা শক্ত সমর্থ আর বিশ্বস্ত।

মুসা আলাইহিস সালামের সাথে নারীদের সাক্ষাৎ ছিল একেবারে  ক্ষণিকের।  খানিক আগেই যার সাথে পরিচয় তারা একটা কথা পর্যন্ত বলেনি যে বিশ্বস্ত শক্ত সমর্থ্য তা তারা বুঝলো কিভাবে ?

তাফসীরে এটা সুন্দর একটা ব্যাখা এসেছে। যে কূপ থেকে মূসা আলাইহিস সালাম মেয়ে দুটোর বকরিগুলোকে পানি খাওয়েছেন,  সেই কূপের মুখে লোহার একটা ঢাকনা ছিল।  ঢাকনাটা এত ভারী ছিল যে, ১০ জন লোক মিলেও সেই ঢাকনা সরাতে বেগ পেতে হতো।  মুসা আলাইহিস সালাম নারীদ্বয়ের বকরিগুলোকে নিয়ে কূপের পাড়ে গিয়ে দেখেন - কূপের কাছে এতক্ষণ যারা ছিল,  তাদের প্রয়োজন ইতিমধ্যেই শেষ হয়েছে এবং তারা কুপের ঢাকনাটা লাগিয়ে দিয়েছে।  নারীদ্বয় খেয়াল করল - কূপের এ ঢাকনার দশজন মিলেও সরানো দায়,  এই ঢাকনা মুসা আলাইহিস সালাম একাই সরিয়ে ফেলেছেন কারো সাহায্য ছাড়াই।  এটা নারীদ্বয়কে বিস্মিত করেছে বটে, কিন্তু সেই বিস্ময় তারা মুসা আলাইহিস সালাম এর কাছে প্রকাশ করেনি। মাশাআল্লাহ সালামের এই কাজ দেখেই তারা বুঝতে পেরেছিলেন যে- তিনি শক্ত সমর্থ্য মানুষ।

তবে তিনি যে বিশ্বস্ত তা কিভাবে বুঝলো ? 

তাফসীরকারকগণ আরো বলেছেন - নারী দুজনের যে জন মুসা আলাইহিস সালামকে ডাকতে এসেছিল ফিরবার পথে সেই নারী আগে আগে হাঁটছিল চলার পথে বাতাসে বারবার তার গায়ের চাদর  সরে যাচ্ছিল বিধায় তাকে  বেশ বিব্রত অবস্থায় পড়তে হচ্ছিল।  এটা দেখে মুসা আলাইহিস সালাম বললেন, আমাকে আগে আগে হাঁটতে দিন।  আমি যদি পথ ভুল করে অন্যদিকে পা বাড়াই আপনি পেছন থেকে একটা পাথর ছুড়ে আমাকে সঠিক পথটা দেখিয়ে দিলেই হবে।

মুসা আলাইহিস সালাম আগে আগে হাটতে চাইলেন এইজন্য যে - বাতাসে যদি মেয়েটার গায়ের চাদোর  সরে ও যাই, তাঁর নজর যেন কোন ভাবেই নিবদ্ধ না হতে পারে।  এতে নিজের এর হেফাজত যেমন হবে , তেমনি বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে বেঁচে যাবে মেয়েটা।  আরো উল্লেখ যে - পথ হারালে  মুসা  আলাইহিস সালাম তাকে পাথর ছুড়ে সঠিক পথ  নির্দেশ করতে বলেছেন,  আওয়াজ করে পথ দেখিয়ে দিতে বলেননি।  ওই অপরিচিতার কণ্ঠস্বর নিজের জন্য উচিত মনে করেন নি তিনি।

আরো পড়ুনঃশিক্ষা

যে লোক নিজের চরিত্র কে নিজের দৃষ্টিকে হেফাজত এতখানি তৎপর যিনি একাকিনী রমনীদের কাছ থেকেও নিজের দৃষ্টিকে এভাবে আড়াল করেন তাকে তো চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করে ফেলা যায়।  সুতরাং তার বিশ্বস্ততার ব্যাপারে রমণীদের চিন্তা এখানে এতোটুকুই অমূলক ছিল না।

আমি ভাবি বর্তমানে শো অফের দুনিয়ায় আলাইহিস সালাম এর জন্য কি চমৎকার দৃষ্টান্তই না রেখে গেলেন!  আজকাল আমরা অন্যকে দেখানোর জন্য কাছে নিজের কোন হাজির কত চেষ্টাই না করি!  আমি এমন অনেক ছেলেকে চিনি যারা অন্যকে দেখানোর জন্য দামি মডেলের বাইক কেনে দামি রেস্টুরেন্টে যাই খেতে।  খুব পরিশ্রম করে সিক্স প্যাক  বডি তৈরি করে যাতে তাকে দেখে অন্যরা বাহবা দেয়।  এমন অনেক মেয়ে আছে যারা দামি কাপড় চোপড় পড়ে সাজগোজ করে অন্যকে আকৃষ্ট করতে।  তাদের রূপ আর লাবণ্য ডুবিয়ে রাখতে চাই অন্যদেরকে।

অথচ মুসা আলাইহিস সালাম মেয়ে দুটোকে কিন্তু তাদের বকরিগুলোকে পানি খাওয়াতে ছুটে যান নি।  তিনি মুগ্ধ করতে চেয়েছিলেন কেবল আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলাকে।  নিজের দৃষ্টি হেফাজত কে তিনি আল্লাহর বিধান মেনে চলেছেন।  মেয়েটিকে সামনে চলতে দিলে তারা দৃষ্টি হেফাজতের সমস্যা হতে পারে শয়তানের ওয়াসওয়াসায় তিনি পরাস্ত হতে পারেন এই ভয় থেকে তিনি আগে আগে চলতে চেয়েছেন।

এই যে কেবল আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্যই কাজ করা আল্লাহর বিধানকে ভালবেসে আঁকড়ে ধরা সর্বদা সর্বশ্রেষ্ঠ থাকা এইসবের বিনিময় হিসেবে মুসা আলাইহিস সালাম কি পেলেন ?

মাদইয়ানে তিনি এসেছিলেন একেবারে অসহায় অবস্থায়। না ছিল কোন আশ্রয় না  কোন খাবার  এর ব্যবস্থা। অথচ এই আপনার জের ধরে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তাঁকে আশ্রয় দিলেন একজন নেক্কার বান্দার গৃহে।  কোন কোন তাফসীরকারকের  মতে ওই মেয়ে দুটোর বাবাও আল্লাহর একজন নবী ছিলেন।  মুসা আলাইহিস সালাম শুধু যে আশ্রয় পেলেন তা কিন্তু নয়, ওই মেয়ে দুটোর একজনকে তিনি নিজের জীবনসঙ্গিনী হিসেবেও পেয়েছিলেন।

তার শক্তি মত্তা  তিনি কাজে লাগিয়েছেন মানুষের উপকারে।  এই উপকার তিনি করেছেন শুধু আল্লাহকে খুশি করার জন্যই।  নিজের ছন্নছাড়া বোঝাতেও তিনি তার চরিত্র তার দৃষ্টির হেফাজতের কথা ভুলে যাননি। এসবের পুরস্কার হিসেবে তিনি লাভ করেছেন একটা উত্তম আশ্রয় তুম জীবন সঙ্গিনী দেখতে পেয়েছেন একজন উত্তম অভিভাবক হিসেবে।

শো অফের দুনিয়ায় আমরা যারা অপরকে মুগ্ধ করার জন্য খেটে খুটে মরি,আমরা আসলে কি পাই দিনশেষে ?

আর মুসা আলাইহিস সালাম, যার ব্রতই ছিল কেবল আল্লাহকে মুগ্ধ করা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা তিনি কি পাননি দুনিয়ার ?  এক মনিসি  কত সুন্দর বলেছেন  সে কি পেল যে আল্লাহকে হারালো?  আর সে কি হারালো যে আল্লাহকে পেল? "